সোমবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১০

সবজি তো খেতেই চায় না

সবজি তো খেতেই চায় না

কানিজ ফাতেমা শম্পা
চিকেন ব্রোস্ট, বিফ স্টু, প্রন কাটলেট বা এগরোল খেতে কোনো আপত্তি নেই, কেবল শাক-সবজির নাম শুনলেই শুরু হয়ে যায় ঐশীর নানান বাহানা। দশ বছরের ঐশীর খাদ্যাভ্যাস যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে সে সবজি খাওয়ার ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। তাই হঠাত্ সবজি খাওয়ানো নিয়ে তার মাকে পোহাতে হচ্ছে নানান ঝামেলা।
আজকাল অধিকাংশ মা এ সমস্যাটির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ ব্যাপারে শিশুদের দোষ দেয়া ঠিক হবে না, কারণ হালফ্যাশনের ফাস্টফুড খাবারের প্রতি নিজেদের অজান্তে বাবা-মাই শিশুদের অভ্যস্ত করিয়ে ফেলছেন। আবার বাবা-মা’র অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকেও শিশুরা সবজি বাদ দিয়ে শুধু প্রোটিন খাবারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। শিশুকাল অর্থাত্ দেড়-দু’বছর বয়স থেকে দশ-বারো বছর পর্যন্ত বেড়ে ওঠার সময়টায় খাবার বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ সময় তাদের খাবার যেন প্রতিটি উপাদানে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হয়ে ওঠে সেদিকটা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ যেমন জরুরি তেমনি টাটকা তাজা মৌসুমি ফল, শাক-সবজি শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে সমান কার্যকরী।
শিশু যখন সবজির প্রতি অনীহা দেখাচ্ছে তখন তার কাছে সবজিটাকে উপস্থাপন করতে হবে একটু অন্যরকমে, অর্থাত্ খুবই মুখরোচকভাবে। এখন শীতের সময়। এ সময় বাইরে পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর টাটকা সবজি, যেমন—গাজর, বাঁধাকপি, বিট, ফুলকপি, বরবটি, ঝিঙ্গে, শালগম, টমেটো ইত্যাদি। সবজি সেদ্ধ করে সামান্য টেস্টি সল্ট ও গোলমরিচ গুঁড়ো ছিটিয়ে ডিম ফেটে তৈরি করা যায় সবজি পাকোড়া। ডিম ময়দার গোলা দিয়ে রুটি তৈরি করে মাঝে সবজির পুর দিয়ে ভেজিটেবল রোল বানিয়ে দেয়া যায়। সবজি পিঠা, স্যুপ, ভেজিটেবল সাসলিক বার্গার, মোগলাই উইথ ভেজিটেবল ফিলার ও সবজি কাটলেট জাতীয় খাবারগুলো শিশুরা অবশ্যই পছন্দ করবে। সবজির পুর তৈরির সময় সামান্য মুরগীর কিমা বা ডিমের ঝুরো খাবারকে আরও মজাদার করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ডেকোরেশন। অর্থাত্ খাবার ডেলিশিয়াস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেকোরেটিভও হতে হবে। তাই শিশুর সামনে খাবার পরিবেশনের সময় যত্নশীল হতে হবে যেন শিশুর সবজি খাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ানো যায়। লেটুসপাতা, শসা, টমেটো, গাঁজর, মেয়নেজ, টমেটো সস ইত্যাদি ব্যবহার করে খাবারের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিতে হবে। যেন শিশু খাবারটা দেখেই সেটা চেখে দেখতে চায়। মনে রাখতে হবে, পরিবেশনের গুণে খাবারের স্বাদ ও সৌন্দর্য দুটোই বেড়ে যায়।
টাইমটেবল মেনে শিশুদের সবজি খাওয়ানো যায় না। তাই সকাল বা বিকালের নাস্তা, দুপুরের খাবারে অথবা হোক না সেটা স্কুলের টিফিন শিশুর খাবারে সবজির একটা টাচ অবশ্যই থাকা চাই। সকালের নাস্তায় রুটি-ভাজি অধিকাংশ শিশুর অপছন্দের খাবার, তাই এ নাস্তাটাকেই একটু অন্যভাবে তৈরি করে দিলে শিশুর খাবারের আগ্রহ সৃষ্টি হবে। ডালবাটাতে গরম মসলার গুঁড়ো মিশিয়ে তাতে কুমড়ো ফুল, ফুলকপি, কাঁচাকলা ইত্যাদি সবজি ডুবিয়ে বড়া ভেজে দুপুরে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করলে শিশু পছন্দ করে খাবে। ঢেঁড়শ, বরবটি, পুঁইশাক ইত্যাদি সামান্য কুঁচো চিংড়ি ও হালকা মসলা দিয়ে রান্না করলেও শিশুরা ভাতের সঙ্গে লেবু দিয়ে এটা খেতে খুব পছন্দ করবে। এমনিভাবে বিকালের নাস্তা বা স্কুলের টিফিনেও নুডল্স্, পাস্তা, ভেজিটেবল রোল, মোগলাই, স্যুপ, স্যান্ডউইচ সব কিছুতে সবজির একটা মুখরোচক ছোঁয়া থাকলে শিশুর মাছাভ্যাসে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সবজি বা নিরামিষ খাবার ব্যাপারে বিশেষ সচেতনতা দেখা দিয়েছে। ধর্মীয় নীতিবোধ, সৌন্দর্য রক্ষা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যরক্ষা, বার্ধক্য রুখতে সর্বোপরি ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও অ্যানিমেল প্রোটিন বর্জন করার জোরদার আন্দোলন শুরু হয়েছে। তাই, একেবারে শৈশবকাল থেকেই শিশুদের মধ্যে সবজি খাওয়ার প্রবণতা গড়ে তুললে শিশুর দেহে সবজির ঘাটতিজনিত রোগ-ব্যাধি এড়ানো সম্ভব। পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ অথচ সস্তা তাজা শাক-সবজি থেকেই শিশু পেতে পারে তার প্রয়োজনীয় ক্যালরি, ভিটামিন, মিনারেলস ও কার্বোহাইড্রেট। লাউশাক, কুমড়োশাক, নটেশাক, মেথিশাক, ঢেঁকিশাক, পুঁইশাক, কচু, কচুর লতি, মটরশুঁটি, সয়াবিন, বরবটি ইত্যাদিতে আছে বিটা ক্যারোটিন। আবার লাইকোপেন রয়েছে টমেটো ও তরমুজে। পাকা কুমড়ো, পাকা আম, পেঁপে ও কমলালেবুতে আছে ক্রিপটোজ্যানথিন। আনারস, টমেটো ও লেবুতে ভিটামিন সি। আটা, ছোলা, সয়াবিন, বাদাম, মুগডালে ভিটামিন ই। এসবই অ্যান্টি অক্সিডেন্টস্, যা কিনা আমাদের শরীরকে ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা জোগায়। আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। তাই প্রতিটি শিশুকে সবজি ও নিরামিষের প্রতি আগ্রহী করে তুললে দেশ ও জাতি পাবে এক সুস্থ, নীরোগ ও দীর্ঘজীবী নাগরিক, যারা হবে স্বাবলম্বীও।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন